Ads Top

কেদারকন্ঠ ট্রেকিং

কেদারকন্ঠ ট্রেকিং


অন্য রুট, ট্রেকিং ও অভিযান, 26/09/2021 : প্রথমদিকের ট্রেক রুটগুলির মধ্যে বেছে নিয়েছিলাম উত্তরাখন্ডের কেদারকন্ঠ ট্রেক রুটটিকে। তবে প্রথমে যতটা কষ্টকর ভেবেছিলাম, ততটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হয় নি আমাকে। দিব্যি পাহাড় চরেছি নেমেও এসেছিলাম। মাত্র দু'দিনের ট্রেক ছিল এই পথে। পৌঁছে গিয়েছিলাম কেদারকন্ঠের শীর্ষে।

কেদারকন্ঠ যেতে হলে প্রথমেই পৌঁছাতে হয় শাঁখরি নামে একটি ছোট পাহাড়ি শহরে। দেরাদুন থেকে সকালের বাসে চড়ে প্রায় 7 ঘণ্টার সফর করে এসে পৌঁছালাম শাঁখরি শহরে। দুরত্ব প্রায় 197 কিলোমিটার। এতটা বাস জার্নি করে কেমন যেন একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। একটা মাঝারি মানের হোটেলে উঠে নিজেকে ধাতস্থ করলাম। ঘড়িতে তখন প্রায় তিনটে বাজতে চলেছে। মুখ চোখ ধুয়ে আগে মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে নিলাম।


এরপর শাঁখরির রাস্তায় বেরিয়ে প্রথমেই গেলাম বাজারে। আজ শাঁখরি শহরটা ঘন কুয়াশায় মুখ ঢেকেছে। রাস্তাতেও লোকজন নেই বিশেষ একটা। মে মাসের শেষ সপ্তাহে শাঁখরিকে দেখে বেশ অলস বলে মনে হচ্ছিল। পথের কুকুরগুলোও কুণ্ডলি পাকিয়ে ঘুমাতে ব্যস্ত। 

হোটেলের মালিক রবি সিং একটা তালিকা করে দিয়েছিলেন। সেই ফর্দ বাজারের একটা দোকানে গিয়ে দেখাতেই দোকানদার প্যাকেট ভর্তি করে আমার হাতে সব কিছু তুলে দিলেন। এই বাজার আমার ট্রেক রুটের রেশন। হোটেলের রবি সিং আগামীকাল ও পরশুর জন্যে একজন গাইডের ব্যাবস্থা করে রাখবেন বলেছেন। 


বাজারে এক কাপ গরম চা খেতে খেতেই দেখলাম শাঁখরির মাথার ওপরের পাহাড় চূড়া গুলি ছাড়া আর কোথাও সেভাবে মেঘের আনাগোনা নেই। আর কিছু সময় পরেই আলো কমে আসবে। সূর্য যাবে অস্তাচলে, অর্থাৎ পাহাড়ের পিছনে।


হোটেলে ফিরেই দেখি রবি সিং আমার জন্যে একজন গাইডকে ডেকে এনেছেন। অল্প বয়সী ছেলেটির নাম চন্দন। ঐ আগামীকাল আমাকে নিয়ে যাবে কেদারকন্ঠ অভিযানে। চট করে আলাপ পর্ব সেরে নিলাম। ওকে দেখালাম, যা কিছু বাজার থেকে কিনে এনেছি।  রাতে মোবাইল চার্জ দিয়ে রাখলাম। 


পরের দিনটা শুরু হল চন্দনের তাগাদা দিয়ে। প্রাতকৃত্য সেরে গরম চা খেতে খেতেই দেখলাম শাঁখরিতে আজ রোদ উঠেছে। হোটেলের বারান্দা থেকেই দেখলাম আকাশ আজ পুরোপুরি মেঘ মুক্ত। ঝলমল করছে চারদিক। ওপরের দিকে তাকাতেই দেখি ঘন নীল আকাশের বুকে পাহাড় চূড়াগুলোও আজকের অভিযানের জন্যে স্বাগত জানাচ্ছে। 

সকাল 9টা নাগাদ আমি আর চন্দন চলতে শুরু করলাম। এবার এই ট্রেক সম্বন্ধে কিছু তথ্য জানিয়ে রাখি। শাঁখরি জায়গাটাকে কেদারকন্ঠ অভিযানের বেস ভিলেজ হিসেবে বর্ণনা করা যায়। উত্তরকাশী জেলা এবং গাড়োয়াল হিমালয়ে অসামান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের মাঝে বেশ ছোট একটি জনপদ এই শাঁখরি জায়গাটা। উচ্চতা 1950 মিটার। এখান থেকেই যেহেতু কেদারকন্ঠ ট্রেকরুটের শুরু এবং বছরের বর্ষাকালটা বাদ দিয়ে অন্যান্য সময়ে বহু ট্রেকার আসেন এখানে, তাই শাঁখরির হোটেল আর হোম স্টেগুলো প্রায় সবকটিই ট্রেকিং এর সাথে যুক্ত। এখানে বেশ কিছু দোকান আছে যেখান থেকে ট্রেকিং এর জন্যে সব রকম সরঞ্জাম ভাড়া পাওয়া যায়। গাইড, পোর্টার সব কিছুই পাওয়া যায়। কেদারকন্ঠ শীর্ষের উচ্চতা প্রায় 3800 মিটার। সুতরাং আমাদের পাহাড় চড়তে হবে প্রায় 1850 মিটার।


শাঁখরি ছেড়ে এগিয়ে আমরা ফরেস্ট অফিসে পারমিট নিয়ে গাইড চন্দনের নাম রেজিস্টারে তুলে প্রবেশ করেছি অরণ্যে। পথ সমানে উর্দ্ধমুখে উঠে গিয়েছে পাইন ও ম্যাপল গাছের বনভূমির মধ্যে দিয়ে। আমরা কিছুটা থেমে থিম এগোতে থাকলাম। 

যতটা ওপরের দিকে এগোচ্ছি, বোতলের জল ফুরিয়ে আসছে। বেশ ঘাম দিচ্ছে। গায়ের হাল্কা গরম জামা খুলে কোমরে জড়িয়ে নিয়েছি। তবে পাহাড়ের উচ্চতা থেকে চারপাশের ভ্যালি দেখতে লাগছিল বেশ সুন্দর। গাড়োয়াল হিমালয়ের সৌন্দর্য, সে তো আমাদের মত ভ্রমণ প্রিয় মানুষকে মুগ্ধ করবেই।


হাল্কা বনপথ পার হয়ে প্রায় 1000 মিটার চড়াই পথে আমরা একটা বুগিয়ালে এসে পৌঁছালাম। সেখানেই রঙ বেরঙের বেশ কয়েকটা তাঁবু দেখতে পেলাম। চন্দন বলল এটাই জুড়া তালাও। আজ এখানেই আমাদের রাত্রিবাস। জায়গাটা বেশ কিছুটা বুগিয়াল। ফাঁকা ঘাস জমি। চারদিকে ঘন পাইন বন। এক পাশে ছোট লেক, নাম জুড়া তালাও বা জুড়া লেক। 

আমার বেশ ক্লান্তি লাগছিল। দেখলাম বুগিযালের এক পাশে একটা ছোট ছাউনি মত রয়েছে। আসলে ওটা একটা ছোট্ট দোকান, ওখানেই গিয়ে বসে পড়লাম। গরম চা আর বিস্কুট খেয়ে শরীরে কিছুটা এনার্জি ফিরে এল। চন্দন ইতিমধ্যেই আমাদের তাঁবু রেডি করে ফেলেছে। বেশ করিৎকর্মা ছেলেটি। তাঁবুর ভিতরে ফোম ম্যাট্রেস বিছিয়ে স্লিপিং ব্যাগের ভিতরে ঢুকে একটু জিরিয়ে নিয়ে ফের বাইরে এলাম। আমি আর চন্দন দুজনে মিলে ঘন্টা দেড়েকের প্রচেষ্টায় তৈরি করে ফেললাম সামান্য খিচুড়ি। তারপর আশেপাশের জায়গাগুলো ঘুরে দেখতে লাগলাম। 


সূর্য ডুব দিতেই জুড়া তালাও বুগিয়াল জুড়ে ঘন অন্ধকার। তবে মাথার ওপর আকাশে হাজার তারার ঝাড়বাতি যেন অন্য জগতে নিয়ে চলে যায়। অন্যান্য ট্রেকাররা দেখলাম মড়া গাছের গুঁড়ি জ্বালিয়ে ক্যাম্প ফায়ার করছে, আনন্দ করছে। রাত হতেই শীতের প্রকোপ বেশ বাড়তে থাকল। হাল্কা খাবার খেয়ে আমরাও স্লিপিং ব্যাগের নিরাপদ সান্নিধ্যে আশ্রয় নিলাম। 

পরদিন সকালে একটু ম্যাগি তৈরি করে চা সহযোগে খ্র্যে নিয়েই হাঁটা পথে পা বাড়িযেছিলাম। আজ প্রায় আটশ-সাড়ে আটশ মিটার উঠতে হবে। আজ পাহাড়ি উচ্চতার সাথে শরীর কিছুটা মানিয়ে নিয়েছে বলেই মনে হল। আজ ধীর গতিতে পাহাড় চড়তে তাই তেমন কষ্ট অনুভব হচ্ছিল না। কিছুটা ওপরে উঠে গিয়ে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে আবার এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কিছুটা উঠতেই হাওয়ার গতিবেগ গেল বেড়ে। তবে রোদ ঝলমলে পরিবেশটা তখনও ছিল। যার জন্যে মনের মধ্যেও একটা বেশ তরতাজা ভাব ছিল। 


একটা উচ্চতায় পৌঁছে দেখলাম অরণ্য রয়ে গেল নিচে। আমাদের চারপাশে সেভাবে গাছপালা নেই। তবে পাহাড়ের গায়ে সবুজ ঘাসের মোড়ক থেকেই গিয়েছে। রোদ খুব চড়া ছিলই, কিন্তু হাওয়ার দাপটে এতটুকুও কষ্ট হচ্ছিল না। আমরা কেদারকন্ঠ চূড়াটা নীচ থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাব। কিন্তু আমরা যতই ওপরের দিকে উঠছিলাম, কেদারকন্ঠ চূড়া যেন কিছুতেই ধরা দিতে চাইছিল না। এর মাঝেই একবার প্রায় আধ ঘন্টা মত বিশ্রাম নিয়ে ফেলেছি। বিস্কুট, চানাচুর আর ক্যাডবেরি দিয়ে কিছুটা পেট ভরিয়ে নিয়েছি। 


শেষমেশ বেশ কিছুটা চড়াই ভেঙ্গে আমরা পৌঁছে গিয়েছি কেদারকন্ঠ চূড়ায়। কিন্তু ওপর থেকে যে দৃশ্য দেখতে পেলাম, তাতে একটু আগে পর্যন্ত যে প্রাণান্তকর পরিশ্রম করতে হচ্ছিল এই জায়গাটায় আরোহণ করার জন্যে, নিমেষে সেইসব উধাও হয়ে গেল । একটা পাথরের ওপর বসে পড়লাম। তারপর জে দিকেই তাকাই দেখি হিমালয়ের সুউচ্চ পর্বত শৃঙ্গরাজি একের পর এক দাঁড়িয়ে আছে মুগ্ধ করা সৌন্দর্যের সাজ সেজে। কি অপূর্ব সেই দৃশ্য ! মনে হল এ কোন পৃথিবী ! যেখানে নেই কোনো কোলাহল ! নেই কোনো কলুষতা, নেই কোনো বিদ্বেষ, নেই রেষারেষি। নেই মলিনতা। আছে শুধু সৌন্দর্য, আছে পবিত্রতা, নির্জনতা, স্বর্গীয় অনুভূতি। আমি অবাক হয়ে দিগন্ত বিস্তৃত হিমালয়কে দেখে যাচ্ছিলাম, সবিস্ময়ে। চমক ভাঙল চন্দনের ডাকে। জুতো খুলে আমরা কয়েক ধাপ ওপরে পাথরের ওপর পাথর সাজানো ছোট্ট একটি মন্দিরে গিয়ে প্রণাম সারলাম। শিব ঠাকুরের মন্দির। বাবা কেদারনাথ। 


বেশ কিছুক্ষণ পর ঘোর কাটতে পা বাড়ালাম ফিরে আসার জন্যে। আজ বিকেলের মধ্যেই পৌঁছাবো শাঁখরিতে। আগামীকাল শাঁখরি ছেড়ে পা রাখবো হিমালয়ের আর এক অলিন্দে।




No comments:

Aaj Khabor. Powered by Blogger.