উইকএন্ড : সুরিয়া (হাজারীবাগ রোড )
![]() |
হাজারীবাগের জঙ্গলে |
অন্যরুট, উইকএন্ড, ২২/১২/২০১৯ : সুরিয়া (হাজারীবাগ রোড ) : সপ্তাহান্তের ছুটিতে কাছেপিঠে কোথায় খুব ভালভাবে কাটানো যায়, এটাই একটা বড় প্রশ্ন। শীতকালে পর্যটনপ্রিয় মানুষের যেন বেড়াতে যাওয়ার ক্ষিধে আরও বেড়ে যায়; তাই কাছেপিঠে কম সময় খরচ করে কিভাবে ঘুরে আসা যায় তার খোঁজ চলতে থাকে। জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রগুলি ছেড়ে ভিড় এড়াতেই একটু অন্য রুটে ঘুরে আসতে কার না ইচ্ছে হয়!
![]() |
ক্যানারি হিলস |
আজ এরকমই একটা জায়গা নিয়ে আলোচনা করব, জায়গাটির নাম হল সুরিয়া। এই জায়গাটির নাম আগে ছিল হাজারীবাগ রোড, (রেলের খাতায় এখনো এই নামটাই আছে) তবে মনে রাখতে হবে, হাজারীবাগ শহরটি কিন্তু এখান থেকে অনেকটাই দূরে। তবে হাজারীবাগ শহরে যাওয়ার জন্যে এখানেই ট্রেন থেকে নামতে হত, জায়গাটি ঝাড়খন্ড রাজ্যে, আর এই জায়গাটি নিয়ে আলোচনা করছি এই কারণে, যেহেতু এখানে বেড়ানো , অবসর সময় কাটানো কিংবা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য সবকিছুই পাওয়া যাবে।
![]() |
ক্যানারি হিল টপ |
একটা সময় বহু বাঙালি শীতকালের পুরোটাই কাটাতো এখানে, এখানকার জল হাওয়ায় দুই বা তিন মাস কাটিয়ে শরীর সুস্থ করত বাঙালি। তবে বাঙালির স্মৃতি বিজড়িত সেই ভ্রমন আজ অতীত। আসুন আজ সেই অতীত ঘেঁটেই বর্তমানের সপ্তাহান্তিক ভ্রমণকে সুন্দর করে তুলি।
সুরিয়া বা হাজারীবাগ রোডে যাওয়ার সবচেয়ে ভাল ট্রেন হল জম্মু তাওয়াই এক্সপ্রেস। কলকাতা স্টেশন থেকে সকাল ১১টা ৪৫ মিনিটে ছাড়ে জম্মু তাওয়াই এক্সপ্রেস। সেই ট্রেন হাজারীবাগ রোড স্টেশন বা সুরিয়া পৌঁছায় সন্ধ্যে ৬টা নাগাদ। হাজারীবাগ রোড (সুরিয়া ) খুব ছোট একটি শহর, সন্ধ্যেবেলায় সেখানে পৌঁছে প্রথমেই হোটেলে চেক ইন করে নিন, তারপর না হয় সন্ধ্যের আলোয় শহরের এপাশ ওপাশ একটু ঘুরে নেবেন।
![]() |
অরোরা পাহাড় |
হাজারীবাগ স্টেশনের একদিকে রয়েছে শহর, আর এক দিকে রয়েছে পরের পর বাগান বাড়ি। এগুলি সবই ছিল বাঙালিদের, এখনো আছে বেশ কিছু। বাগানবাড়ি দেখতে দেখতে ঘুরে বেড়াতে বেশ ভাল লাগবে। স্টেশন থেকেই একদিকে টেম্পল রোড এগিয়ে গিয়েছে, ডান হাতে পড়বে একটি মন্দির। পথ আরও এগিয়ে গিয়েছে শহরের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে, জঙ্গলের দিকে। অত্যুত্সাহীরা ঘুরে আসতে পারেন, তবে হেঁটে যেতে হবে, যদি হোটেল থেকে সাইকেল পেয়ে যান, তাহলে পথশ্রম লাঘব হবে; হাজারীবাগ রোডের এই অঞ্চলে বহু বিখ্যাত বাঙালির পদধূলি পড়েছে একটা সময়, আচার্য্য জগদীশ চন্দ্র বসু, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু অনেকেই এসেছেন এখানে। ভোরবেলায় হাজারীবাগের পথে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ুন, গ্রামের মেঠো পথ ধরে ঘুরে বেড়ান যেখানে ইচ্ছে, যতটা ইচ্ছে। তৃষ্ণা নিবারণ করুন মিষ্টি খেজুর রস দিয়ে। বুক ভরে শ্বাস নিন, দূষণ শব্দটিই নেই হাজারীবাগের অভিধানে। কোলাহল বিহীন হাজারীবাগ ব্যস্ততা বিহীন অসাধারন সপ্তাহান্তিক অবসর উপহার দিতে পারে। আপনার ব্যস্ততা থাকবে শুধু ছবি তোলার জন্যে, আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের সবটুকু চেটেপুটে উপভোগ করে নেওয়ার জন্যে।
![]() |
হাজারীবাগ অরণ্যের পথে |
হাজারীবাগ স্টেশন থেকে একটি রাস্তা শহরকে ভেদ করে চলে গিয়েছে জিটি রোডের দিকে। একটা সময় এই রাস্তাটি অরণ্যের মধ্যেই ছিল, এখন অবশ্য সব ফাঁকা; এই রাস্তার ওপারেই বসে থাকত চিতার দল, এখন ঘুরে বেড়ায় ছাগলের দল; রাস্তাটি সোজা গিয়ে পৌঁছায় জিটি রোডে। জায়গাটির নাম বগোদর, পথে পড়বে ঘন অরণ্যাবৃত অরোরা পাহাড়। বগোদর থেকে আরও ঘণ্টাখানেক সড়কপথে রয়েছে হাজারীবাগ টাউন। হাজারীবাগ রোড থেকে হাজারীবাগ টাউনের দূরত্ব সড়কপথে প্রায় ৭০ কিলোমিটার। বাসেও যাওয়া যায়;
![]() |
পরেশনাথ পাহাড় |
বগোদর থেকে জিটি রোড ধরে পশ্চিমদিকে আরও এগিয়ে গেলে দুটি খুব সুন্দর জায়গায় পৌঁছানো যায়; প্রথমটি হল হাজারীবাগ ওয়াল্ড লাইফ স্যাংচুয়্যারী । বগোদর থেকে দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার। পথ গিয়েছে বারহি পর্যন্ত, সেখান থেকে বাম দিকে ঘুরে পথ গিয়েছে অরণ্যের তোরণে। একটা সময় চিতা ও বাঘেদের দেখা প্রচুর পরিমাণে দেখা পাওয়া গেলেও এখন তাদের সংখ্যা অনেক কম হয়ে গিয়েছে এই অরণ্যে। তবে হায়না, নীলগাই ও চিতল হরিণ রয়েছে প্রচুর। পাখিও রয়েছে অনেক। এই অরণ্যের উচ্চতা ২০১৮ ফুট. কাছাকাছি রয়েছে ক্যানারি হিলস, যেখান থেকে অরণ্য এবং পাহাড়ের নিসর্গ উপভোগ করা যায়;
![]() |
শিখরজী |
বগোদর থেকে রাজ ধানোয়ার রোড ধরে ১২৬ কিলোমিটার দূরে রয়েছে কাকোলাত নামের অসাধারন সুন্দর একটি জায়গা। এখানে চারদিকে পাহাড় ঘেরা একটি লেক রয়েছে, শীতকাল জুড়েই পিকনিকের ভিড় থাকে, এই জায়গাটিকে এই রাজ্যের কাশ্মীর বলা হয়; রয়েছে একটি দুর্দান্ত জলপ্রপাত, যেখানটায় জলপ্রপাত এসে পড়ছে, সেখানে তৈরী হয়েছে সুন্দর একটি প্রাকৃতিক সুইমিং পুল; বেশ উপভোগ্য জায়গাটি।
![]() |
হাজারীবাগ রোড স্টেশন |
হাজারীবাগ রোড থেকে আর একদিন চলুন পরেশ নাথ দেখতে। ধানবাদ স্টেশন ছাড়ালেই আসবে গোমো স্টেশনটি, এটি হল সেই ঐতিহাসিক স্টেশন যেখান থেকে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর মহানিষ্ক্রমণের জন্যে ট্রেন যাত্রা শুরু হয়েছিল। এই স্টেশন থেকেই তিনি জম্মু তাওয়াই এক্সপ্রেস ট্রেনে উঠেছিলেন, তাঁর গুম হয়ে যাওয়া থেকেই স্টেশনের নাম গোমো। পরের স্টেশনটিই পরেশনাথ, স্টেশনের বাইরে থেকে শেয়ার জিপ বা বাস ধরে আধ ঘণ্টার দূরত্বে (১০ কিলোমিটার) পৌঁছে যেতে হবে পরেশনাথ পাহাড়ের নিচে মধুবনীতে। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে চড়তে হবে পাহাড়ের মাথায়, ঘন অরণ্য ভেদ করে উঠে গিয়েছে পাহাড়ি পথ, কোথাও কোথাও রয়েছে সিঁড়ি, ধীর পদক্ষেপে সামান্য ট্রেকিং করে পৌঁছাতে হবে পাহাড়ের মাথায়, সেখানে রয়েছে জৈন ধর্মের সবচেয়ে বড় তীর্থ ক্ষেত্র মহাবীরের বেশ কয়েকটি মন্দির। এই জায়গাটিকে শিখরজিও বলা হয়; (পাহাড়ের ওপর সেভাবে খাবার কিছু পাবেন না , চা, বিস্কুট, ভুজিয়া ছাড়া); পাহাড়ের মাথা থেকে চারপাশের দৃশ্য অত্যন্ত মনোরম। পরেশনাথ পাহাড়ের নিচে মধুবনীতে রয়েছে প্রচুর ধর্মশালা যেখানে রাত্রিবাস করা যায়; মধুবনী থেকে হাজারীবাগের দূরত্ব ৮০ কিলোমিটার আর আর এক সুন্দর জায়গা ঝুমরি তালাইয়ার দূরত্বও ৮০ কিলোমিটার। পরেশ নাথের পরের স্টেশনটিই হল হাজারীবাগ রোড; এই রেল লাইনের ধারে পড়বে টিয়াপল নামে একটি ঢিবির মতন জায়গা, যেখানে হাজারে হাজরে টিয়া পাখি দল বেঁধে উড়ে বেড়ায়।
![]() |
কাকলাত |
হাজারীবাগের অদূরেই বয়ে গিয়েছে বরাকর নদী, প্রচুর বোল্ডারে ধাক্কা খেতে খেতে হাঁটু সমান স্বচ্ছ সলিল বয়ে গিয়েছে, ওপারে কোডারমা; একদিন পড়ন্ত বিকেলবিকেলে বরকরের সোনালী বালুকাবেলায় ছোট্ট পিকনিক সারাজীবন মনে রাখতে পারবেন। হাজারীবাগ রোড থেকে ৫১ কিলোমিটার দূরে রয়েছে গিরিডি। গাড়িতে বা বাসে যেতে সময় লাগে ঘণ্টা দেড়েক, একটা দিন গিরিডি থেকেও ঘুরে আস্তে পারেন। গিরিডিতে রয়েছে উশ্রী জলপ্রপাত, যাকে বলা উচিত সুশ্রী জলপ্রপাত। আর রয়েছে হরিহর ধাম, যেখানে গেলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিব লিঙ্গটি দেখতে পাওয়া যায়।
হাজারীবাগ রোডে বেড়াতে গেলে এমন অনেক মানুষের সাথে দেখা হাতে পারে যাঁরা বাংলা ভাষায় কথা বলেন। এখানে কালিবাবুর দোকানের কচুরি আর কালাকাঁদ খুব বিখ্যাত। দুই বা তিনটি দিন কাটিয়ে আসুন হাজারীবাগ রোড থেকে, যেখানে হয়ত আপনার পূর্বপুরুষরা বেড়াতে যেতেন স্বাস্থ্য ফেরাতে। এখানে এখন বেশ কয়েকটি হোটেল হয়েছে রাত্রিবাসের জন্যে, যেমন অর্জুন রেস্ট হাউস - 97086 48162, গীতা নিবাস - 76673 74434, এছাড়াও রয়েছে ছোট ছোট আরও কিছু হোটেল, স্টেশনের পাশেই রয়েছে রেলের গেস্ট হাউস। খুব ভাল হয় দিন কয়েকের জন্যে এখানে কোনো বাঙ্গালী বাগানবাড়ি ভাড়া করে নিতে পারলে। কয়েকটা দিন কাটবে একটু অন্য রকম। তবে মনে রাখবেন শীতকালে এই অঞ্চলে শীতের প্রকোপ খুব বেশি, তাই পর্যাপ্ত শীতের পোশাক সঙ্গে রাখবেন।
No comments:
Post a Comment