ট্রেকিং ও অভিযান : দুর্যোধনের দেশ হর কি দুন
![]() |
বরফের উপত্যকায় |
![]() |
তালুকা থেকে ট্রেক শুরু |
গাড়োয়াল হিমালয়ের অসাধারণ গন্তব্য এই হর কি দুন, এলপাইন অরণ্য বেষ্টিত এই জায়গাটি থেকে যেদিকেই তাকানো যায় না কেন, দেখা যাবে বরফাবৃত শৃঙ্গগুলি যেন চারদিক থেকে পাহারা দিচ্ছে। জায়গাটির উচ্চতা ১১৬০০ ফুট, অক্টবর থেকে মে মাস পর্যন্ত আদর্শ সময় এখানে ট্রেকিং করার। এই উপত্যাকার দূরত্ব তালুকা গ্রাম থেকে ২৬ কিলোমিটার। এই উপত্যকা বরাসু পাস্ দিয়ে বসপা উপত্যাকার সাথে যুক্ত রয়েছে। এখান থেকে স্বর্গারোহিনীও যাওয়া যায়, যে পথ ধরে পঞ্চপান্ডবরা স্বর্গে আরোহন করতে চেয়েছিলেন।
![]() |
আকাশের বুকে বন্দরপুঞ্ছ শৃঙ্গ |
হর কি দুন জায়গাটির সাথে পৌরাণিক মহাকাব্য মহাভারতের যোগ বেশ ঘনিষ্ট। শোনা যায় কাছাকাছি গ্রাম ওসলাতে একটি বংশ বাস করত যারা কৌরব রাজ পুত্র যুধিষ্ঠিরের অনুগত ছিল, সম্ভবত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে তারা কৌরবদের সাহায্যও করেছিল। আর এক উপকথায় শোনা যায়, দুর্যোধন একবার কৃষ্ণের হাত দিয়ে কোনো বার্তা পাঠিয়েছিলেন পান্ডবদের, সেই বার্তা নিয়ে কৃষ্ণ যখন এই অঞ্চল দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তাঁর এই জায়গাটি খুব ভাল লেগে যায়, তিনি কিছুদিন থেকে যান এখানে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই গ্রামের লোকেদের কাছে কৃষ্ণের ব্যবহার নিয়ে মহিলারা অভিযোগ করায় গ্রামবাসীরা উপত্যকা থেকে কৃষ্ণকে বের করে দেয় ; এইসব কারণেই এখানে কৃষ্ণের পূজা হয় না, ঘরে ঘরে পূজিত হন দুর্যোধন।গ্রামে রয়েছে দুর্যোধনের একটি প্রাচীন মন্দির। দুর্যোধনকেই ভগবান বলে মনে করেন এখানকার স্থানীয় মানুষজন।
![]() |
বয়ে চলেছে সুপিন নদী |
যাই হোক, এবার আসা যাক ট্রেকিং এর কথায়। হর কি দুন ট্রেকিং শুরু হয় তালুকা গ্রাম থেকে। মোট ৫ দিনের ট্রেক, দুই ভাগে ভাগ করে করা হয়; প্রথম দিনে তালুকা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে সীমা বা ওসলা গ্রামে পৌঁছাতে হয়, দ্বিতীয় দিনে সীমা বা ওসলা থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে শিমাত্রায় পৌঁছাতে হয়; তৃতীয় দিনে শিমাত্রা থেকে হর কি দুন ঘুরে আবার ফিরে আসতে হয় শিমাত্রাতে, ওঠা নামা মিলিয়ে মোট ১২ কিলোমিটার। চতুর্থ দিনে শিমাত্রা থেকে ওসলা ফিরে আসতে হবে, মোট ৮ কিলোমিটার আর পঞ্চম দিনে ওসলা থেকে নেমে যেতে হবে তালুকা গ্রামে। সেখান থেকে গাড়িতে চলে যাওয়া যাবে শাঁকরি গ্রামে। এনার্জি থাকলে চতুর্থ ও পঞ্চম দিনের ট্রেক একদিনেও করে নেওয়া যায়; তবে একটু রয়েসয়ে নামাই ভাল.;
![]() |
ওসলা গ্রাম |
উত্তরাখণ্ডের কিছু ট্র্যাভেল এজেন্সি এই পথে ট্রেকিং এর প্যাকেজ করায়। তাদের প্যাকেজগুলিতে সাধারণত থাকে - শাঁকরি থেকে শাঁকরি পর্যন্ত মোট ৬ রাত্রি / ৭ দিনের সফর; সরকারি প্যাকেজও পাওয়া যায়;
- ১ম দিন - প্রথম দিনে আপনি শাঁকরি এসে পৌঁছালেন, হোমস্টেতে রাত্রিবাস, সূর্যের আলো থাকতে থাকতে গ্রামটি একটু ঘুরে দেখে নিতে পারেন।
- ২য় দিন - সকালবেলায় জিপ পৌঁছে দেবে ১২ কিলোমিটার দূরের তালুকা গ্রামে। এখন থেকেই পায়ে হেঁটে চলার শুরু। একটি কাঠের সেতু পার করে সুপিন নদীর পাশ দিয়ে পথ চলে গেছে উর্দ্ধ মুখে। পথ চলতে চলতে আশেপাশে দেখবেন আরো কিছু পায়ে হাঁটা পথ চলে গেছে, আপনাকে রুট পরিবর্তন করলে চলবে না, মূল পথ ধরেই এগোতে হবে, না হলে সোজা চলে যাবেন যৌসারি গ্রামে। ৮ কিলোমিটার হাঁটার পর নদীর ধরে দেখতে পাবেন ছবির মত সুন্দর গংগার গ্রামকে, এখন থেকে দুই ঘন্টার ট্রেক আপনাকে পৌঁছে দেবে ওসলার কাছে সীমা গ্রামে, সীমা গ্রামেও থাকতে পারেন, বা পোহানি গারহাটেও থাকতে পারেন।
- ৩য় দিন, সুপিন নদীর ওপর বড় সেতুটি পার করে পথ ক্রমশ: উর্দ্ধমুখী, এখানে একটি প্রাণান্তকর চরাই ভেঙে উঠে গিয়ে পাবেন একটি ঝোরা , আর তার ওপর একটি ছোট সেতু। এখন থেকে আরো ৪ কিলোমিটার এগিয়ে পাবেন একটি সবুজ বুগিয়াল। একটু বিশ্রাম নিয়ে এগিয়ে যান, আরও কিলোমিটার দুয়েক এগোলে পাবেন দেবসু ঠাক ও রুইনসারা উপত্যকা , যেখান থেকে আপনার পিছনে তাকালেই দেখতে পাবেন কালা নাগ শৃঙ্গ ও বন্দর পুঁছ পর্বত শৃঙ্গকে। এই দৃশ্য কার্যত পথশ্রমকে লাঘব করে দেয়; এরপর কালকাটি ধার পার করে আপনি প্রবেশ করবেন গোবিন্দ বল্লভ পন্থ ওয়াইল্ড লাইফ রিজার্ভএ । এরপর সামান্য এগোলেই দেখতে পাবেন হাটা শৃঙ্গকে, এই হাটা শৃঙ্গের নিচেই অবস্থান হর কি দুনের, এতক্ষন যে সব সুন্দর সুন্দর জায়গা পার করে এসেছেন, তার মধ্যে সেরা জায়গা এই হর কি দুন উপত্যকা, এখানে ক্যাম্প করে থাকুন।
- চতুর্থ দিনে ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠে দেখুন স্বর্গারোহিনী শৃঙ্গের পিছন থেকে উদয় হচ্ছে দিবাকরের। যদি ইচ্ছে হয় এখন থেকে আর একটু বেরিয়ে নিতে পারেন, এখন থেকে দুটি শর্ট ট্রেক রুট আছে, একটি হল যৌধার হিমবাহ, যাওয়া আসা নিয়ে মোট ১৫ কিলোমিটার, আর অপরটি হল মানিন্দা তাল, যাওয়া আসা মিলিয়ে মোট ৬ কিলোমিটার। দুটি ট্রেকরুটই বেশ কঠিন, তবে অনেক ট্রেকার যান, যেতে গেলে দুটি বিষয়ে অবশ্যই সজাগ থাকতে হবে, এক, শরীর অনুমতি দিচ্ছে কিনা এবং দুই, আবহাওয়া অনুমতি দিচ্ছে কিনা। পাহাড়ে গিয়ে হঠকারিতা একেবারেই বাঞ্ছনীয় নয়;
- ৫ম দিনে, একই পথে ফিরে আসুন ওসলা গ্রামে, সীমা গ্রামের উল্টোদিকেই এই গ্রাম। কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে গ্রামের মানুষের সাথে আলাপ জমান।
- ষষ্ঠ দিনে, ওসলা থেকে নেমে আসুন তালুকা গ্রামে। সেখান থেকে জিপে করে শাঁকরি গ্রামে ফিরুন, রাত্রি কাটান সেখানকার হোমস্টেতে।
- ৭ম দিনে, খুব সকাল সকাল শাঁকরি থেকে দেরাদুন যাওয়ার বাস বা গাড়ি ধরুন।
![]() |
ওসলা গ্রামের একটি মন্দির |
ট্রেকিং প্যাকেজ করুন উত্তরাখন্ড পর্যটন উন্নয়ন নিগমের সাথে। ফোন - ০১৩৫ ২৬৯৫৮৭৯ / ৮৯৮৯১২৪৪৯৯ নম্বরে। কলকাতার ডালহৌসিতে মার্শাল হাউসে অফিস রয়েছে উত্তরাখন্ড পর্যটন নিগমের, রুম নম্বর - ২২৪, ফোন - ২২৬১ ০৫৫৪;
![]() |
হর কি দুনের দুর্যোধন মন্দির |
দেরাদুনের রেল স্টেশনের পাশে মুসৌরি বাস স্ট্যান্ড থেকে সকাল বেলায় তিনটি বাস ছাড়ে সরাসরি শাঁকরি যাওয়ার জন্যে। বাস ছাড়ে ৫:৩০, ৬:৩০ ০ ৭:৩০ মিনিটে। কোনো কারনে এই বাসগুলি মিস করলে হানল বাস ভায়া মুসৌরি ধরুন, আর মোরিতে নেমে যান; সেখান থেকে শাঁকরি পৌঁছনোর শেয়ার গাড়ি বা জিপ পেয়ে যাবেন। দেরাদুন থেকে গাড়ি ভাড়া করেও সরাসরি পৌঁছে যাওয়া যায় শাঁকরিতে ; দেরাদুনে একাধিক ট্র্যাভলস আছে, কথা বলতে পারেন, প্রত্যেকের ভাড়া এক হবে না, তবু মোটামুটি ভাড়া এরকম - ডিজায়ার বা ইন্ডিগো - ৫৫০০/-, ইনোভা - ৮০০০/-, জাইলো - ৭০০০/- আর টেম্পো ট্র্যাভেলার ৯৫০০/- ;
অন্যরুটের অন্যান্য ভ্রমন বিবরণগুলি দেখতে লগ অন করুন - www.anyoroute.blogspot.com
No comments:
Post a Comment